মায়াবী রাক্ষস *
সে অনেকদিন আগের কথা। - রূপসাগরের তীরে এক বিরাট রাজপুরী ছিল। সকালের আলােয় সেই রাজপুরী ঝন্ম করে উঠত! চাদের আলােয় তাে তার রূপই হতাে আলাদা। রূপসাগরের তীরে অপরূপ এই রাজপুরী যারা দেখতাে, তারাই অবাক হয়ে যেত।
এই রাজপুরীর যিনি রাজা, তিনি বড় দয়ালু। রাজ্যের কোন প্রজা তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি চুপ করে বসে থাকতেন না। কিভাবে কার উপকার হবে, মন্ত্রী- অমাত্যদের সঙ্গে বসে আলােচনা করে সে সব ঠিক করতেন। | রাজার এক ছেলে। ছেলেটি বড় আদরের। রাজা রাণী আদর করে তার নাম রেখেছিলেন সােনামাণিক। সােনামাণিকের রূপের সীমা ছিল না। সােনার। মত গায়ের রং, চোখ দুটো যেন ঝিকমিক্ দু'টুকরাে মাণিক। বাবার মত ছেলেরও মনটি বড়াে ভাল। সকলকে সে ভালবাসে, সকলের সঙ্গে সে মেলামেশা করে। রাজার ছেলে বলে তার কোন অহংকার নেই।
একদিনের ঘটনা। রাজামশাই রাজকার্য সেরে রাজপুরীর দিকে চলেছেন, এমন সময় গাঁয়ের এক গরীব ধীবর জোড়হাত করে রাজার সামনে এসে দাঁড়ালাে।
রাজামশাই বললেন—কি ব্যাপার? তুমি এমন করে পথের সামনে এসে দাঁড়ালে কেন? তােমার কি আবেদন আছে?
ধীবর বললে—হুজুর, আমি বড়াে গরীব। সমুদ্রে মাছ ধরে যা উপায়। করি, তাতে আমার সংসার চলে না। আমার সংসারে অনেক লােক, একার উপায়ে আর কি করে চালাবাে বলুন? দু'বেলা দু'মুঠো ভাত, তাও ছেলেরা। খেতে পায় না। তাদের দেখে আমার চোখ ফেটে জল আসে।
ধীবর জোড়হাত করে বললে আপনার যা দয়া হয় আপনি করুন। হুজুর।
রাজা বললেন-তােমার তাে অনেকগুলি ছেলেমেয়ে! তুমি তােমার। ছােট ছেলেটিকে আমার কাছে দাও, আমি তাকে নিজের ছেলের মতই মানুষ করবাে। এ ধীবর এতটা আশা করতেই পারেনি, সে রাজার প্রস্তাব শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে বললে—মহারাজ, এতাে আমার পরম সৌভাগ্য। আমি ছােট ছেলেকে কালকেই আপনার কাছে এনে দেবাে। আপনার দয়ায় সে মানুষ হলে আমারই উপকার।
বাড়ি ফিরে ধীবর তার স্ত্রীকে সব কথা বুঝিয়ে বললাে। কিন্তু মায়ের মন, ছেলেকে রাজার কাছে হলেও দিতে কি আর মন চায়? অনেক বলে কয়ে তবেই ছেলেটাকে ধীবর রাজার কাছে নিয়ে এলাে। রাজা ধীবরের ছেলেকে দেখে খুশী হলেন। ছেলেটির গায়ের রঙ কালাে, কিন্তু চোখ দুটি বড় সুন্দর। অযতনে শরীর দুর্বল। রাজা বললেন—ছেলের নাম থাক্ মুক্তো! এই বলে তিনি মুক্তোকে বুকের কাছে টেনে নিলেন।
সােনামাণিক আর মুক্তো। একজন রাজার ছেলে আর একজন ধীবরের | ছেলে-তফাৎ অনেক। কিন্তু রাজা সে তফাৎ রাখলেন না, দুটি ছেলেকে একেবারে এক করে নিলেন।
যারা দেখে তারাই বলে—এরা যেন ঠিক এক মায়ের পেটের ভাই। একসঙ্গে খেলা, একসঙ্গে বেড়ানাে আর একসঙ্গে একই বিছানায় ঘুম। এমনটি। কোথাও দেখা যায় না। রাজা দেখেন, দেখে তার বুক আনন্দে ভরে।
কিন্তু বাজার আনন্দ হলে কি হবে রাণীর মনে বড়াে হিংসা। পরের | ছেলে মরে রাজার এতাে বাড়াবাড়ি তার সহ্য হয় না।
সােনামাণিক কিন্তু তার মায়ের সব কথা বুঝতে পারে, সে দুঃখও পায়। খুব; কিন্তু কারােকে সে সেকথা বলতে পারে না।
দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল সােনামাণিক আর মুক্তো। মায়ের শাসনও। বাড়লাে। রাজার চোখের আড়াল হলেই বাণী কারণে অকারণে মুক্তোকে শাসন করেন, কটু কথা বলেন।
মুক্তো খুব কষ্ট পায়। দিন দিন মা যে কেন তাকে এতাে বকাঝকা করেন। সে, বুঝতে পারে না। রাজাকেও সে এ-নিয়ে কখনাে নালিশ করে না। | একদিন সামান্য কারণে মায়ের শাসন আর সহ্য হল না মুক্তোর। সে। মনে মনে ভাবলাে, রাজপুরীর মায়া কাটিয়ে সে কোথাও চলে যাবে। মা যদি তাকে ভাল না বাসেন, তাে কি হবে এখানে থেকে? রাজাকে কিছু না বলে, সােনামাণিককে কিছু না জানিয়ে সে এক ভােরে রাজপুরী ত্যাগ করল। _ চলতে চলতে একসময় শহর ও গ্রামের পথ শেষ হল। সামনে এবার বন আর বন! গাছে গাছে জট পাকিয়ে আছে। মুক্তো একাকী সেই বনের মধ্যে প্রবেশ করল। সে ঠিক করেছে, যেদিকে তার দু'চোখ যাবে, সেখানেই সে যাবে। দেখা যাক, কত দূরে সে পথের শেষ হয়। | সূৰ্য্য ডুবে গেল। অমনি অন্ধকার হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারা বনের মধ্যে। কোনরকমে ঝােপ-ঝাড়ের পাশ কাটিয়ে চললাে মুক্তো। কিন্তু চলতে তার খুবই কষ্ট; পা-হাত সারা গা কাটা আর খোচা লেগে ক্ষত-বিক্ষত, খিদের জ্বালায় নাড়িতে পাক দিচ্ছে, পা আর চলতে চাইছে না।
এদিকে রাত বেড়ে চললাে, অন্ধকার ঘন হল, আর বনের মধ্যে শোঁ-শোঁ | করে কেমন একটা শব্দ হতে লাগল। ভীষণ ভয় পেয়ে মুক্তো দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই অন্ধকারের মধ্যে।
এমন সময় এক পরী এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেই সে দাঁড়ালাে, অমনি জায়গাটা ঝলমল করে উঠল।
পরী বললে—কি-গাে ছেলে, কোথায় যাবে তুমি? এতাে অন্ধকারে পথ। চলবে কেমন করে?
পরী বললে তুমি কেন এসেছ তা বুঝতে পারছি। তুমি এবার বাড়ি ফিরে যাও, সবাই তােমার জন্য খুব দুঃখ করছে।
মুক্তো মাথা নাড়ল, বলল-“আমি আর ফিরে যাবাে না।
পরী বললে--যদি ফিরে না যাও তাে আমি আর কি বলবাে। তবে একটা কথাই বলি—তুমি এই বনে সাবধানে পথ হাঁটবে। এখানে এক শয়তান বাস করে, সে নানারকম যাদু জানে। নিজে সে কখনাে থাকে। দুশিংওয়ালা হলদে সাপ হয়ে, কখনাে দুই শিংওয়ালা রাক্ষস হয়ে! তােমাকে দেখলেই কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে গুহার মধ্যে বন্দি করে ফেলবে। খুব সাবধান! এই বলে পরী আবার কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। | আবার চারিদিক অন্ধকার, চোখে ধাধা লেগে গেল মুক্তোর। কোথাও পথ নেই, শুধু গাছের জটলা। তবু সেই বাধা ঠেলে মুক্তো আবার এগুতে লাগল। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই সে থমকে দাঁড়ালাে। ফেস-ফোস করে ঠিক সাপের আওয়াজ হচ্ছে সামনে!
তবে কি এখনি এসে গেল মায়াবী সাপ! কিন্তু হাতে কোন অস্ত্রও নেই যে সাপের সঙ্গে মােকাবিলা করবে। ভাবতে না ভাবতেই শিংওলা সাফ মুক্তোর সামনে এসে ফণা দোলাতে লাগল। বাপ-রে কী তার ফণা! দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।
মুক্তো কিন্তু সাপের দিকে চেয়ে বেশীক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল। না। তার মনে হতে লাগল, কে যেন তাকে সামনের দিকে টানছে।
আসলে সাপ ততক্ষণে যাদু করে ফেলেছে মুক্তোকে। সাপ ফণা তুলে যেদিকে যাচ্ছে, মুক্তোও এক-পা এক-পা করে সেইদিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
খানিকটা এগিয়ে যাবার পর পড়ল এক পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে এক গুহা। সেই গুহার মধ্যে মুক্তো যেই ঢুকলাে, অমনি বেরুবার পথ বন্ধ গেল; আর তক্ষুণি মুক্তোকে বন্দী করে একটা সুড়ঙ্গ পথ দিয়া মায়াবী সাপ বেরিয়ে গেল বাইরে।
পরীর কথায় সাবধান না হয়ে কী ভুলই না করেছে মুজো। সে গুহার। ধ্য ঘােরে- ফেরে আর কাদে। সাপ যখন আসে, তখন তার কাছে সে। তনেক কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু মায়াবী সাপ শিং নাড়ে আর ফণা দুলিয়ে শিয় দেয়—মায়া তার হয় না। তবে সাপ একটু দয়া করে সে বন থেকে। ফলমল মাথায় করে এনে দেয় মুক্তোকে, মুক্তো তাই খায়। আর গুহার পাশ দিয়ে ঝিরঝির শব্দে যে ঝর্ণাটা বয়ে যাচ্ছে, তার জল পান করে তেষ্টার সময়।
ওদিকে রাজপুরীতে সােনামাণিকের চোখে ঘুম নেই। মুক্তো তার ভাই, সে তাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতাে। সেই ভাই তার চলে গেছে কতদিন হল! সােনামাণিক কারােকে কিছু বলে না লুকিয়ে লুকিয়ে কাদে।
একদিন কারােকে কিছু না বলেই কাদতে কাদতে সে বেরিয়ে পড়ল। পথে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করলাে—যেমন করেই হােক, সে তার ভাইকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেই। একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করবে তারা রাজপুরীতে।
রাজপুরী ছেড়ে একসময় রাজপুত্র এসে পড়ল সেই বনের পথে। যেই | না সে ঢুকলাে বনপথে, অমনি সূৰ্য্য গেল ডুবে। আর যেই না সূর্য ডুবে
যাওয়া, অমনি ঘাের অন্ধকার নেমে এলাে বনের মধ্যে। রাজপুত্রের দুটো -চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেল। সব ঝাপসা, সব কুয়াশার মত। দু’টো হাতে | হাতড়ে সে পথ খুঁজতে লাগল; আর ঠিক সেইসময় সেই পরী এসে রাজপুত্র সােনামাণিকের সামনে হাজির হল। সােনামাণিককে বললে-ছেলে, কোথায়। যাবে? | সােনামাণিক নির্ভয়ে বললে—আমার ভাইকে আমি খুঁজতে যাচ্ছি।
পরী বললে-যাও, কিন্তু এই অন্ধকারে খুব সাবধানে পথ চলাে। এক। মায়াবী শয়তান এখানে থাকে শিংওয়ালা সাপ হয়ে। তার খপ্পরে পড়েছ কি রক্ষে নেই। | সােনামাণিক বললে—আপনি তাে পরী, আপনি তাে সব জানতে পারেন। বলুন তাে আমার ভাই কোথায় আছে?
0 Comments